Saturday, March 24, 2012

নক্ষত্রের কারিগর

বারো বছর বয়সী এক কিশোরের একবার ইচ্ছে হলো কাচের জারে একটা তারা তৈরি করবে। এরপর, তার বয়স চৌদ্দ পুরো হতে না হতে ঠিকই তেমন একটা তারা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিলো বিশ্বকে। না কোনো খেলনা তারা নয়। সত্যিকারের একটুকরো নক্ষত্রই বানিয়েছিলো সে। সূর্যের এবং অন্য আর সব নক্ষত্রের মধ্যে মধ্যে যেমন হাইড্রোজেন ফিউশন রিয়াকশনের মাধ্যমে অন্য পরমাণুতে পরিণত হয়। সঙ্গে উৎপন্ন হয় শক্তি, যেটাকে আলো আর তাপ হিসাবে আমরা দেখি, অনুভব করি। ঠিক তেমন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার ঘটাতে পেরেছে সে তার বাড়ির গ্যারেজে। নিজের ছোট্টো পরমাণুগবেষণা কেন্দ্রে। ছেলেটির নাম টেইলর উইলসন। এভাবেই সে আরো একবার প্রমাণ করেছে, প্রচেষ্টা থাকলে কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়।

ছোটোবেলা থেকেই টেইলর ছিলো কৌতূহলি। আর দশজন ছেলেমেয়ের মতই। তবে আর দশজনের থেকে তার পার্থক্য ছিলো উদ্যমে। কোনো একটা ব্যাপারে কৌতূহল বোধ করলে তা যতই জটিল মনে হোক, লেগে থাকতো সে। এবং এক সময় সেগুলো বুঝে ফেলতো ঠিকই। আসলে কোনো কিছু বুঝে ফেলার মধ্যে যে কী অভাবনীয় আনন্দ, তার খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলো সে আরও অনেক আগেই। তাই তো ৯ বছর বয়সে এক মহাশূন্য ও রকেট গবেষনাকেন্দ্রের  জাদুঘরে রকেট ইঞ্জিন দেখতে গিয়ে কীভাবে সেটা কাজ করে তার পুংক্ষাণুপুংক্ষ বর্ণণা দিয়ে চমকে দিয়েছিলো সবাইকে। পরে এক দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে রকেটসাইন্স রেখে পরমাণু গবেষণায় আগ্রহী হয়ে টেইলর।

সেই বছর তার দাদির মৃত্যু হয় ক্যানসারে। আমরা জানি ক্যানসার নামক এই মারণ ব্যাধির কোনো ভালো চিকিৎসা নেই। কেমোথেরাপি নামক এক রকম আংশিক চিকিৎসা প্রচলিত, যেখানে শরীরের মধ্যে বিষাক্ত সব রাসায়নিক দ্রব্য ঢুকিয়ে দেওআ হয়, আর আশা করা হয় এগুলো গিয়ে সেই ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোকে মেরে ফেলবে। এমন এক ধরনের কেমো থেরাপিতে শরীরের মধ্যে তেজস্ক্রিয় পরমাণু ঢুকিয়ে দেওআ হয়। এরা গিয়ে তেজষ্ক্রিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেরা ক্ষয় হয়ে অন্য ধরনের পরমাণুতে পরিণত হয়, আর নানা রকম তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বিকীরণ করে। আর এই রশ্মিগুলোই ক্যানসার কোষকে মেরে ফেলে। এক সময় এই ভয়ংকর পরমাণুগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। আর তখন যদি ক্যানসারকোষগুলো সব মারা গিয়ে থাকে, মানুষটি সুস্থ হয়ে ওঠে। যদিও এই চিকিৎসা সব সময় কার্যকর হয় না এবং প্রচুর সুস্থ কোষও মারা পড়ে এতে। কিন্তু এর চেয়ে খুব ভালো চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

এখন এই তেজস্ক্রিয় পরমাণুগুলো যদি দ্রুত ক্ষয় হতে হতে নিঃশেষ না হয়ে দীর্ঘ্যদিন ধরে একটু একটু করে ক্ষয় হতো, তাহলে সেই আক্রান্ত ব্যক্তি হয়তো ক্যানসারের বদলে তেজস্ক্রিয়তায় ভুগতে ভুগতেই মারা পড়তো। এ কারণেই এই চিকিৎসায় শুধু সেইসব তেজস্ক্রিয় পরমাণু (এদের বলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ) ব্যবহার করা হয় যারা গঠনগত কারণেই বেশ দ্রুত ক্ষয় হয়। আর এখানেই দেখা দেয় সমস্যার। যে বড় বড় গবেষণাগারে এসব আইসোটোপ তৈরি হয়, সেখান থেকে খুব দূরের কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে ওগুলোকে নিতে নিতেই হয়তো ক্ষয় হয়ে নিঃশেষে হয়ে পড়ে এরা। এমন কি অনেক দূরের কোনো রোগীকে চিকিৎসা করতে কখনও প্রাইভেট জেটে করেও এগুলোকে দ্রুত বয়ে নিতে হয়। এদেরকে সংরক্ষণ করাও সম্ভব নয়। তাই সাধারণ কারো পক্ষে এই চিকিৎসা হয়ে পড়ে প্রায় অসম্ভব। টেইলর তার দাদির ক্ষেত্রেও এই কেমিক্যালগুলোর দুস্প্রাপ্যতা লক্ষ্য করেছিলো। আর তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় এই অতিপ্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আইসোটগুলো নিজেই বানিয়ে ফেলবে সে। কিন্তু তেজস্ক্রিয় আইসোটপ সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি করা যায় না। এর জন্য লাগে নিউক্লিআর বিক্রিয়া। আর তার জন্য প্রয়োজন পারমানবিক চুল্লি। কিন্তু এই চুল্লি সে কোথায় পাবে?

আমরা অনেকে হয়তো পেপার-পত্রিকায় বা টিভি-ইনটারনেটে পরমাণুচুল্লি দেখে থাকবো। কিন্তু আমরা কি জানি, যে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় পরমানুচুল্লিটাকে আমরা দেখি প্রতিদিনই? সেটা হচ্ছে সূর্য। শুধু সূর্য না, যে অসংখ্য তারা দেখি আমরা রাতে সেগুলোও একেকটা পরমাণুচুল্লি। এদের কেউ কেউ সূর্যের চেয়েও বড়, কিন্তু বহু আলোকবর্ষদূরে হওয়ায় এদেরকে ছোটো দেখায়। আর এদের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া। নির্দিষ্ট করে বললে হাইড্রোজেন ফিউশন বিক্রিয়া। যেখানে একাধিক হাইড্রোজেন পরমানু মিলে হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। আর নির্গত করে আলো সহ নানান রকম তেজস্ক্রিয় কণিকা। টেইলর সিদ্ধান্ত নেয় নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এমন এক টুকরো তারাই বানিয়ে ফেলবে সে। যাতে সেই বিক্রিয়ায় উৎপন্ন নিউট্রনের সাহায্যে কেমোথেরাপিতে প্রয়োজনীয় আইসোটোপগুলো বানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। আর শুধু এই তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া ঘটাতে পারলেই চলবে না, তার ফিউশন রিয়্যাক্টরটিকে হতে হবে ছোটোখাটো। যেন দূর দূরান্তের হাসপাতালগুলোতে এ ধররনের রিয়াক্টর বানিয়ে সেখান থেকেই কেমোথেরাপির জন্য প্রয়োজনীয় রেডিও আইসোটোপ তৈরি করা সম্ভব হয়। আর এভাবেই সে স্বপ্ন দেখে কাঁচের জারে একটা তারা তৈরির।

টেইলর উইলসন একজন কিশোর হলেও সে হচ্ছে সেই শ্রেণীর মানুষ যারা নিজের স্বপ্নকে অবহেলায় দূরে ঠেলে দিতে পারে না। পাঠিয়ে দিতে পারে না বৃদ্ধাশ্রম বা কোনো অনাথ আশ্রমে। কবর দিতে পারে না, কোনো অসম্ভবের ভয় বা আলস্যের নীচে। তাই এই স্বপ্নটাকে বাস্তবায়নের জন্যও সে উঠে পড়ে লাগে। একে একে শিখে নেয় ক্যালকুলাস সহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের গণিত, আধুনিক পদার্থবিদ্যা, আর রসায়ন। ফিউশন বিক্রিয়ায় ঘটার সময় ৫০০ মিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রার প্লাজমা উৎপন্ন হয়। এটাকে পৃথিবীর কোনো পাত্রেই রাখা সম্ভব নয়। যেকোনো কিছুকেই গলিয়ে নিমেষে ধ্বংস করে ফেলবে সেটা। তাই এই প্রচন্ড ফিউশন বিক্রিয়ার প্লাজমাকে চৌম্বক ও তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যে ভাসিয়ে রাখতে হয় সুক্ষ্ম ভারসাম্যে। ইরেনিয়াম দিয়ে যে পারমানবিক চুল্লি চালানো হয়, সেখানে হয় ফিশান বিক্রিয়া। অর্থাৎ বড় একটা পরমাণু ভেঙ্গে ছোটো ছোটো পরমাণু তৈরি হয় ওতে। এই বিক্রিয়ার বিঃধ্বংসি ক্ষমতা আমরা সবাই জানি। দুর্ঘটনার আশংকাও থাকে তাই অনেক। কিন্তু টেইলরের বিক্রিয়াটা 'ফিউশন' বিক্রিয়া। যেখানে ছোটো ছোটো হাইড্রোজেনের পরমানু (আসলে হাইড্রোজেনের ডিউটেরিআম নামক একটা আইসোটোপ) মিলে বড় হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। এই বিক্রিয়াকে চালিয়ে নিতে এর প্লাজমাকে খুব সূক্ষ্মভাবে শূন্যে ভাসিয়ে রাখতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই এটা কোনো কিছুর সংস্পর্শে এসে, তাপমাত্রা হারায়, এবং বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাই ফিউশন বিক্রিয়ায় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রের মত উত্তপ্ত এই প্লাজমা কেন্দ্রকে সুক্ষ্মভাবে ভাসিয়ে রাখা যেনতেন কথা নয়। তড়িৎচৌম্বকত্বের গুড়তত্ত্বগুলো শিখে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলো বানাতেঅ জানতে হবে। টেইলর একে একে শিখে নেয় সবই। তৈরিও করে ফেলে সব, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। শুনতে অসম্ভব মনে হলেও নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভয় না পেলে যে কোনো কিছুই সম্ভব সেটা প্রমাণ করে ছাড়ে সে। তার বাড়ির গ্যারেজে, সে বানাতে সক্ষম হয় একটা প্রচন্ড উজ্জ্বল নীলচে বেগুণী তারা।

এখানেই থেমে থাকেনি টেইলর। এগুলোর সাহায্যে ঠিকই, কেমোথেরাপিতে প্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আইসোটোপও বানাতে সক্ষম হয় সে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের জন্য কয়েকশ ডলার দামের এমন একটা [বিষফোরক সনাক্তকারী] ডিটেক্টরও বানাতে সক্ষম হয়, যেটা লক্ষ ডলারের ডিটেক্টরের থেকেও শত গুণে বেশি সংবেদনশীল। টেইলর মনে করে এই ফিউশন বিকারকের মাধ্যমেই একদিন বিশ্বের শক্তির চাহিদা পূরণ হবে।

এতকিছু শেখার জন্য টেইলর নানান সময়ে যোগাযোগ করেছে, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সাথে। তারাও সাগ্রহে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে তথ্যের মূল উৎস ছিলো ইনটারনেট। 'ফিউজর ডটনেট' [১] নামক একটা ওয়েবসাইটই আছে, যেখানে ফিউশন বিকারক বা ফিউজর বানানোর উপায় নিয়ে আলোচনাকরে আগ্রহীরা। নিজেদের আবিষ্কারকে একে সবার সাথে উন্মুক্তভাবে শেয়ারও করে। ইনটারনেট সংযোগ আছে, এমন প্রতিটি মানুষের নাগালের মধ্যেই আছে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে সকল তথ্য। চাই শুধু স্বপ্ন দেখার আর তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরিশ্রমের সাহস।

সূত্র:-
[১] ফিউজর ডট নেট http://www.fusor.net/
[২] টেইলরকে নিয়ে 'পপুলার সাইন্স' নামক অলনাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আর্টিকেল http://www.popsci.com/science/article/2012-02/boy-who-played-fusion?page=all
[৩] টেইলর এর টেড প্রোফাইল - http://www.ted.com/speakers/taylor_wilson.html
[৪] টেইলরের নিজস্ব ওয়েবসাইট - http://sciradioactive.com/Taylors_Nuke_Site/About_Me.html

[৫]  টেইলরের তিন মিনিট দীর্ঘ টেড বক্তৃতা - -

Yup, I built a nuclear fusion reactor




Saturday, March 17, 2012

কসমস পাঠ: নিউটন পর্ব

১৬৯৬ সাল। সুইস গণিতবিদ জোহান বার্নুলি সমকালীন গণিতবিদদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তখনো পর্যন্ত অনিস্পন্ন একটা সমস্যার ব্যাপারে। নাম barichistochrone problem. শুরুতে বার্নুলি সমাধানের জন্য ছয়মাসের সময় সীমা বেধে দিয়েছিলেন, কিন্তু পরে গণিতিবিদ লিবনিৎজ এর অনুরোধে সেই সময় বাড়িয়ে দেড় বছর করেন। বোঝাই যাচ্ছে, এটা কোনো যেনতেন সমস্যা নয়!
১৬৯৭ সালের জানুয়ারী মাসের ২৯ তারিখ, ঘড়িতে বিকাল চারটা। এমন সময় নিউটন চ্যালেঞ্জটার কথা জানতে পারেন। এবং পরদিন সকালে অফিসে আসার আগেই, তিনি গণিতের নতুন একটা শাখাই আবিষ্কার করে ফেলেন, নাম ক্যালকুলাস অফ ভ্যারিয়েশন্স। এবং সেটা ব্যবহার করে barichistochrone সমস্যাটা সমাধান করে সেই সমাধান আবার ডাকে পাঠিয়েও দেন প্রকাশনার জন্য। নিউটনের অনুরোধে সমাধাণটি বেনামীতে প্রকাশিত হয়। কিন্তু সমাধানটির স্বকীয়তা, আর চমৎকারিত্বই নিউটনের পরিচয় ফাস করে দেয় শেষে! বার্নুলী সেই বেনামী সমাধানটা হাতে পেয়ে বললেন, “we recognize the lion by his claw.” নিউটনের বয়স তখন ৫৫ বছর।
এই চির অকৃতদার মানুষটি তারা পুরো জীবনই গাণিতিক ব্যাপারে ক্ষুরধার ছিলেন। অবশ্য বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বেশ খিটমিটে, আর মুডি হয়ে পড়েন। এসব দেখে সমকালিন অনেকেই বলত নিউটনের হয়তো নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। তবে এসবের কারণ অন্য কিছুও হতে পারে। নিউটন সারা জীবনই রসায়ন, (তৎকালিন আলকেমি) চর্চা করে গেছেন। এবং সে সময়, বিভিন্ন যৌগ/মৌল সনাক্ত করনের একটা প্রচলিত ধাপ ছিলো, জিভে নিয়ে স্বাদ গ্রহন করে দেখা! ক্রমাগত এসব করতে গিয়েই তিনি আর্সেনিক এবং মার্কারি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হন বলে ধারনা করা হয়।
গণিত ও বিজ্ঞানের প্রতি তার আগ্রহী হয়ে ওঠার গল্পটাও চমকপ্রদ। ১৬৬৩ সালে এক মেলা থেকে নিউটন জ্যোতিস শাস্তের (মানে ভাগ্যগণনা আরকি) উপর একটা বই কেনেন। বয়স তখন তার ২০ বছর। এই বইতে তিনি একটি বৈজ্ঞানিক চিত্র পান যেটা কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলেন না। কারণ তখনও তিনি ত্রিকোনোমিতি জানতেন না। তাই সেটা বোঝার জন্য তিনি কিনলেন এক ত্রিকোনোমিতির বই। কিন্তু ত্রিকোনোমিতি পড়তে গিয়ে নানান রকম জ্যামিতিক যুক্তি এসে হাজির হলো সামনে। অগত্যা, জ্যামিতির মাস্টারপিস ইউক্লিডের ইলিমেন্টস বইটাই কিনে পড়তে লাগলেন। এর দু বছর পরে তিনি ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেন। তার বয়স তখন কেবল ২২ পেরিয়েছে!
ছাত্রাবস্থায় নিউটনকে সবচেয়ে কৌতূহলি করে তুলেছিলো আলো এবং সূর্য। তিনি প্রায়ই সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতেন! একবার এক আতশ কাঁচ দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ঝলসে গেল! সে সময়ের যন্ত্রণা নিয়ে তাকে লিখতে দেখি,
“In a few hours I had brought my eyes to such a pass that I could look upon no bright object with neither eye but I saw the Sun before me, so that I durst neither write nor read but to recover the use of my eyes shut myself up in my chamber made dark three days together & used all my means to divert my imagination from the Sun. For if I thought upon him I presently saw his picture though I was in the dark.” (COSMOS pg, 87)
১৬৬৬ সালে প্লেগ ছড়িয়ে পড়লে, নিউটন নিজের গ্রামের বাড়ি ফিরে যান। বাধ্য হয়েই এই এক বছর অলস সময় কাটাতে হয় তাকে। এবং অলস সময় কাটানোর সবচেয়ে মজাদার উপায় আর কী হতে পারে, বিজ্ঞান আর গণিতের যুগান্তকারী সব আবিষ্কার করা ছাড়া? এবছর তিনি, মেতে থাকেন ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস নিয়ে, আবিষ্কার করেন ইন্ট্রিগাল ক্যালকুলাস, আলোর ব্যাপারে মৌলিক অনেক আবিষ্কার করতে সক্ষম হন এবং তার মহাকর্ষ সূত্রের মূল ধারণাগুলোও দাড়া করান এ সময়েই। এর সঙ্গে তুলোনীয় আর একটা বছরই আছে পৃথিবীর ইতিহাসে, ১৯০৫ সাল। যখন আইনস্টাইন তার আবিষ্কারগুলো করেন। ভবিষ্যতেও এমন কিছু হবে নিশ্চয়ই, অন্য কারো হাতে!
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারগুলো তিনি কীভাবে করলেন? এই প্রশ্ন করা হলে নিউটনকে উত্তর দিতে দেখা যায়, ‘By thinking upon them’. তার এসময়ের কাজগুলো এতই গুরূতপূর্ণ ছিলো যে কেমব্রিজে তার শিক্ষক আইসাক বারোও নিজের পদ ছেড়ে দেন নিউটনের জন্য যায়গা করে দিতে! (আমাদের দেশে কোনো নিউটন জন্মালে তার জন্য কোনো শিক্ষক এমন করবে কি না সেটা ভাবার বিষয়)
মধ্যচল্লিশে নিউটন কেমন ছিলেন সেটা জানা যায় তার এক ভৃত্যের বর্ণনায়, “I never knew him to take any recreation or pastime either in riding out to take the air, walking, bowling, or any other exercise whatever, thinking all ours lost that were not spent in his studies, to which he kept so close that he seldom left his chamber unless [to lecture] at term time… where so few went to hear him and for want of hearers, read to the walls.” (COSMOS, pg 87)
কেপলারের মত নিউটনের ছাত্ররাও জানলো না তারা কী হারালো!
নিউটন কেপলারের তিনটা সূত্র থেকে এদের মূল কারণ, মধ্যাকর্ষণের বিপরীতবর্গীয় সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। এ নিয়ে গর্বকরে নিউটন তার Principia তে লেখেন, “I now demonstrate the frame of the System of the World”. তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তিনি যে কেপলারের সূত্রগুলো থেকেই তার মধাকর্ষণ সূত্রের ক্লু পেয়েছিলেন সেটা আর এই বইতে উল্লেখ করেননি। তবে ১৬৮৬ সালে অ্যাদমন্ড হ্যালির (হ্যালির ধুমকেত যার নামে) সাথে এক পত্রালাপে তিনি উল্লেখ করেন, “I can affirm that I gathered if from Kepler’s theorem about twenty years ago.” (COSMOS pg. 88)
কেপলার এবং নিউটন মানব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। তারাই প্রমাণ করেন যে প্রকৃতি কিছু সরল গাণিতিক নিয়ম মেনে চলে, যেটা এই পৃথিবীতে যেমন সত্য, দূর নক্ষত্রবীথিতেও একই রকম সত্য, এবং আমাদের চিন্তা সেই সূত্রকে আবিষ্কার করতে সক্ষম। সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের আধুনিক ধারণা, এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের যাবতীয় অনুসন্ধানই এই দুজনের অন্তর্জ্ঞানের প্রতি গভীরভাবে দায়বদ্ধ।
নিউটন যদিও নিজের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর সম্পর্কে বেশ রক্ষনশীল ছিলেন। এবং ভিন্নমত প্রকাশকারী অন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা প্রদর্শন করতেন। কিন্তু প্রকৃতির সূচারু রহস্যময়তা সম্পর্কে ছিলেন টলেমি বা কেপলারের মতই মুগ্ধ ও বিনয়ী। মৃত্যুর কিছু আগে তাই তাকে লিখতে দেখি, “I do not know what I may appear to the world; but to myself I seem to have been only like a boy, playing on the seashores, and diverting myself, in now and then finding a smoother pebble or a prettier shell than ordinary, while the great ocean of truth lay all undiscovered before me.” (COSMOS pg 90)

Friday, March 16, 2012

কসমস পাঠ: কেপলার পর্ব

যুগে যুগে গল্প কবিতা লিখতে গিয়ে বিপদে পড়েছে অনেকেই। কিন্তু সে তো মেইন স্ট্রিম সাহিত্য। সাইন্স ফিকশন লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছে এমন কারো নাম কি বলতে পারেন? উত্তরটা শুনলে অবাক হতে হয়, এই কল্পবিজ্ঞান লেখকের নাম জোহানেস কেপলার! হ্যা, ইনিই সেই মহান কেপলার যে সর্বপ্রথম গ্রহ গুলোর পরাবৃত্তাকার কক্ষপথ আর সে সংক্রান্ত তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেন। বস্তুত, কেপলারের সূত্র থেকেই পরে নিউটন তার অভিকর্ষের বিপরীত বর্গীয় সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। তবে কেপলারের অবদান ছিলো অন্যখানে। কেপলারের আগে গ্রহ নক্ষত্র এসব নিয়ে মানুষের ধারণা ছিলো ভাসা ভাসা। ভাবা হতো অলৌকিক দেবদেবীদের কারবার এসব। তবে এদের আচরণের ছন্দগুলো ধরতে পেরেছিলো মানুষ। কিন্তু সেই ছন্দের মূলসূত্র কারো জানা ছিলো না। এমনকি এ ধরনের কোনো মূলসূত্র আছে কি না সেটাই জানতো না কেউ। সবাই ভাবতো গ্রহ নক্ষত্রের গতি দেবদেবীদের ইচ্ছা মাফিক চলে। কেপলারই প্রথম দেখাতে সক্ষম হন, সব গ্রহ নক্ষত্রের গতিকেই একসূত্রে গেথে ফেলা সম্ভব। বস্তুত, তার আবিষ্কার থেকেই পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়, যে পৃথিবী ও বাকি গ্রহরা সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই তো ধর্মগুরুদের চক্ষুশূল হবার কথা। তাহলে কল্পবিজ্ঞানের জন্য তিনি বিপদে পড়লেন কীভাবে?
যাই হোক, এ বিষয়ে ডিটেইলে লেখাটা পরে গুছিয়ে তৈরি করা যাবে। আপাতত ইন্টারেস্টীং যে ব্যাপারগুলো জানলাম কেপলার সম্পর্কে সেগুলোর তালিকা করি,
কেপলার ধরতে পেরেছিলো, মহাবিশ্বের মূল নিয়মগুলো কোনো দৈব চরিত্রের, খেয়াল খুশিতে হয় না। গণিতের সার্বিকতা সম্পর্কেও তার ধারণাটা অমূল্য। আমরা তাকে তাই বলতে শুনি,
‘Geometry existed before the Creation. It is co-eternal with the mind of God… Geometry provided God with a model for the Creation… Geometry is God Himself’ (COSMOS, pg 70)
বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করার পরে, কেপলার অস্ট্রিয়ার গ্রাজ নামক স্থানে, এক সেকেন্ডারি স্কুলের গণিত শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি শুধু যে একজন মহান চিন্তাবিদ ছিলেন তা-ই না, তার লেখনীও ছিলো ঝরঝরে। কিন্তু ক্লাসরুমে শিক্ষক হিসাবে তার অবস্থা ছিলো শোচনীয়। কথা বলতে গিয়ে অ্যা, ওঁ... করতেন। বেশিরভাগ সময়ই কী বলছেন তা আর বোঝা যেতো না। প্রথম বছরে তাও গুটিকয় ছাত্র ছিলো তার। পরের বছর থেকে, তার ক্লাসে আর কোনো ছাত্রই আসতো না।
বোঝাই যাচ্ছে, যে তার আয়-ইনকামের অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। ওদিকে তার স্ত্রীও ছিলো একেবারেই সাধারণ মহিলা। কেপলারের গাণিতিক প্রতিভাকে মূল্যায়ন করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না তার পক্ষে। রীতিমত অশান্তির সংসার। স্কুলের গণিত শিক্ষক, যার কাছে আবার কেউ পড়তেই আসে না, তেমন কারো স্ত্রী কী বুঝবে তার স্বামীর চিন্তার গভীরতা? কী বুঝবে কেন কেপলার লেখে-
‘The intense pleasure I have received from this discovery can never be told in words… I shunned no calculation no matter how difficult. Days and nights I spent in mathematical labors, until I could see where my hypothesis would agree with the orbits of Copernicus or whether my joy was to vanish to thin air’. (COSMOS, pg 72)
কিন্তু যত ভাবেই তিনি চেষ্টা করুন না কেন, তার প্রাথমিক অনুমানের সাথে, গ্রহসমূহের কক্ষপথের হিসাব কোনোভাবেই মিলছিলো না। কিন্তু নিজের তত্ত্বের সৌন্দর্য্য আর বুদ্ধিদীপ্ততা (elegance) তাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিলো যে সে ভেবেছিলো নিশ্চয়ই তার হাতে যে পর্যবেক্ষণ লব্ধ উপাত্ত আছে, সেগুলোতেই কোনো গলদ আছে। কিন্তু সেই সময়ে, সবচেয়ে সূক্ষ পর্যেবক্ষণলব্ধ উপাত্ত ছিলো একজন স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকা ডেনিস গনিতবিদ টাইকো ব্রাহের কাছে। টাইকোব্রাহে তখন, রোমান সম্রাটের রাজকীয় গণিতবিদ। এবং সৌভাগ্যই বলতে হয়, কীভাবে কীভাবে যেন কেপলারের গাণিতিক প্রতিভার কথা পৌছে গেছিলো টাইকোব্রাহের পৃষ্ঠপোষক রোমান সম্রাট রৌডলফ ২ এর কাছে। এবং তার পরামর্শেই টাইকোব্রাহে কেপলারকে নিজের দলে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পাঠান।
এক দূরবর্তী, প্রদেশের মামুলি স্কুল শিক্ষক হয়ে টাইকোব্রাহের মত এত নামকরা এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তির সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়ে কেপলার আত্মবিশ্বাস হীনতায় ভুগছিলেন। এবং যোগ দেবেন কি না তাই নিয়ে এক রকম মানসিক দোলাচালের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু ইতিহাস তার হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো। ঘটনাটা ঘটে ক্যাথলিকদের সঙ্গে প্রোটেস্টান খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধের সুচনার সময়কার ঝামেলা থেকে। কেপলারের স্কুল, যেটা ছিলো প্রোটেস্টান্টদের জন্য, বন্ধ হয়ে যায়। সেখানকার ক্যাথলিক আর্চডিউক ঘোষণা দেন, এই বেদাত প্রোটেস্টান্ট গুলোর বদলে, একটা মরূভূমিও ভালো। তাই তাদেরকে বিতাড়ন অথবা নিঃশেষের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শহরের বাসিন্দাদের জড়ো করা হয় নিরীক্ষার জন্য। সবাইকে নিজেদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসের খাটিত্বএর পরীক্ষা দিতে হয়। যারা ক্যাথলিক বাদে অন্য কোনো ধর্মের ছিলো, তাদেরকে নিজের আয়ের এক দশমাংশ জরিমানা করা হয়, এবং মৃত্যুর হুমকি দিয়ে ঐ অঞ্চল থেকে চিরতরে বিতাড়ন করা হয়। কেপলার ওদের সাথে আপোষ করার বদলে নির্বাসনকে বেছে নেন। লেখেন,
“Hypocracy I have never learned. I am in earnest about faith. I do not play with it.”
নিজের স্ত্রী আর সৎ মেয়েকে নিয়ে প্রাগ এ টাইকোব্রাহের সাথে যোগ দিতে রওনা দেন তিনি। স্ত্রীর সাথে সাংসারিক অশান্তি তখন তুঙ্গে। বকাঝকার মত অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে গেছে দুয়েকবার। এসব নিয়ে কেপলারকে বলতে শুনি,
“for my studies sometimes made me thoughtless; but I learned my lesson, I learned to have patience with her. When I saw that she took my words to heart, I would rather have bitten my own finger than to give her further offense.”
কেপলারের আশা ছিলো, টাইকোব্রাহের কাছে যাবার পরে, সে তার সংগ্রহ করা উপাত্তগুলো দেখতে পারবে। এবং গ্রহের কক্ষপথের একটা কার্যকর তত্ত্ব দাড় করাতে পারবে। কিন্তু ওখানে পৌছে তাকে আশাহত হতে হয়। নিজের এত কষ্টের ফসল এক নবীন গণিতবিদ এসে নিয়ে যাবে, এটা কোনো ভাবেই মানতে পারছিলেন না টাইকোব্রাহে। তাই কোনো তথ্য দেখাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। অবশ্য, মাঝে মধ্যে এটা ওটা জানাতেন কথার ফাকে। টাইকোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় তার স্বর্ণের নাক থেকেই। আসল নাকটা তিনি খুইয়েছিলেন ছাত্রাবস্থায়। অন্য এক ছাত্রের সাথে, কে সেরা গণিতবিদ সেই নিয়ে ডুয়েল লড়তে গিয়ে! তার আশে পাশে নানান রকম সহকারি, চাটুকার, লেজুড়বৃত্তিকারীরা ঘিরে থাকতো। কেপলার তাই লিখেছেন, ‘Tycho … is superlatively rich but knows not how to make use of it. Any single instrument of his costs more than my and my whole family’s fortunes put together.’
টাইকো কেপলারকে তার সংগ্রহে থাকা উপাত্ত না দেখানো সম্পর্কে কেপলার লিখেছেন, ‘Tycho possesses the best observations… he also has collaborators. He lacks only the architect who would put all this to use.’ (COSMOS 74)
আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মই এভাবে জড়িয়ে পড়েছিলো, এই দু জনের ব্যক্তিত্বের দ্বন্দের মাঝে। কেপলার যোগ দেওয়ার ১৮ মাস পরে, খাবারে অনিয়মের ফলে ইউরিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে পড়েন টাইকো ব্রাহে। এবং এই অসুস্থতাতেই তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যু শয্যায়, টাইকো তার পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্য উপাত্ত কেপলারের নামে দিয়ে যান। তারপর সে রাতে তাকে ঘোরের মধ্যে প্রবল আকুতিতে  বার-বার বলতে শোনা যায়, “Let me not seem to have lived in vain… Let me not seem to have lived in vain.” এভাবেই তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর পর টাইকোর পরিবারের কাছ থেকে উপাত্তগুলো সংগ্রহ করতেও অনেক ঝামেলায় পড়তে হয় কেপলারকে। কারণ কোনোভাবেই তারা সহযোগীতা করছিলো না। তবে একসময় তিনি সেগুলো হাতে পান।
এরপর কেপলার দিনের পর দিন অঙ্ক কষে গেছেন। চিন্তা করে গেছেন, পৃথিবীর সাপেক্ষে মঙ্গলের আপেক্ষিক গতির যে উপাত্ত টাইকো সংগ্রহ করেছিলো একযুগেরও বেশি সময় ধরে, টেলিস্কোপ আবিষ্কারেরও আগে। সেগুলো নিয়েই দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন কেপলার। এই যে বহু ক্যালকুলেশন কেপলার করেছেন, সেগুলো পড়তে গিয়ে একঘেয়েমিতে ভোগা পাঠকদের উদ্দেশ্যে তাই তাকে লিখতে দেখি, ‘If you are wearied by this tedious procedure, take pity on me who carried out at least seventy trials.’ (COSMOS 76)
টানা তিন বছর গাণিতিক হিসাব করার পরে কেপলার মঙ্গল গ্রহের জন্য প্রায় সঠিক একটা বৃত্তাকার কক্ষপথের সূত্র বের করে ফেলেন। যেটা টাইকোর প্রায় দশটা পর্যবেক্ষণের সাথে, দুই মিনিট কোনের মধ্যে মিলে যায়। ঊল্লেক্ষ্য, একডিগ্রির ৬০ ভাগের এক ভাগ হচ্ছে এক মিনিট। ব্যাপারটা বেশ সন্তোষজনক। কিন্তু কেপলারের আনন্দ কেটে যায় অতি দ্রুতই। কারণ টাইকোর আরও দুইটা পর্যবেক্ষণ কোনোভাবেই তার বৃত্তাকার কক্ষপথের সূত্রের সাথে মিলছিলো না। এবং প্রায় আট মিনিট বিচ্যুতি দেখা দিচ্ছিলো। (খেয়াল করুন, আট মিনিট কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে খুবই কম)। কিন্তু কেপলারে বৈজ্ঞানিক চেতনা ছিলো একজন সত্যিকার মহান চিন্তাবিদের মতই। এই সূক্ষ্মবিচ্যুতিকেও তিনি তাই অবহেলা করেণনি। এবং নিজের তত্ত্বকে আবারও নতুন করে গড়তে বসেছেন। এ প্রসঙ্গে তাকে লিখতে দেখি, “If I had believed that we could ignore these eight minutes, I would have patched up my hypothesis accordingly. But, since it was not permissible to ignore, those eight minutes pointed the road to a complete reformation in astronomy.”
এভাবেই এক সময় তিনি পরাবৃত্তাকার কক্ষপথের সূত্রগুলো বের করতে সক্ষম হন। কেপলারের সূত্র গুলো এতইটাই সার্বিক যে, বহু কোটি আলোক বর্ষ দূরের, কোনো নক্ষত্রের কোনো গ্রহ, বা উপগ্রহ বা ধুমকেতু... এসবের কক্ষপথই এই একই নিয়ম মেনে চলে। এই যে সর্বপ্রথম মানুষ হিসাবে কিছু জেনে যাওয়া, সে প্রসঙ্গে কেপলার লেখেন, “I am writing the book- to be read either now or by posterity, it matters not. It can wait a century for a reader, as God Himself has waited 6000 years for a witness.”
এবং এর পর বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার জন্য কেপলার একটা সাইন্স ফিকশন লেখেন। হয়তো এটাই প্রথম কোনো কল্পবিজ্ঞান গল্প। এর নাম ছিলো Somnium যার অর্থ ‘The Dream’। এখানে তিনি কল্পনা করেন চন্দ্র অভিজানের! সে গল্পে, মহাকাশচারীরা গিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে দেখে প্রিয়তম পৃথিবীকে। যেটা তখন রাতের আকাশে ধীর গতিতে আবর্তিত হচ্ছে। পাঠকের দৃষ্টিকোনকে পৃথিবী পৃষ্ঠ ছাড়িয়ে অন্য একটা মাত্রা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এগুলো লেখা। সে সময় পৃথিবী ঘুরছে, এই ধারনাটা কেউ গ্রহন করতে চাইতো না কারণ, কেউ ব্যাপারটা অনুভব করতো না। সোমনিয়াম গল্পে কেপলার তাই চেষ্টা করেন, কল্পনার মাধ্যমে পাঠককে সেই ব্যাপারটা অনুধাবনে সাহায্য করতে। এমন একজন মহান গণিতবিদ কল্পবিজ্ঞান লেখার মত একটা যন্ত্রনা কেন সহ্য করলেন? এ প্রসঙ্গে তাকে লিখতে দেখি, “As long as the multitude does not err, … I want to be on the side of the many. Therefore, I take great pains to explain to as many people as possible.”
কিন্তু এই গল্প লেখা তার কাল হয়। তিরিশ বছর ব্যাপী ধর্মযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। আর যেকোনো যুদ্ধের মত সেখানেও, সবচেয়ে বড় শিকার হচ্ছে নারীরাই। কেপলারের পৃষ্ঠপোষক এই ধর্মযুদ্ধে নিহত হয়েছে আগেই। কেপলার তাই থাকে তার নিজের শহরে। সেখানে প্রতি বছরই গড়ে তিনজন মহিলাকে ডাইনি সন্দেহে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কেপলারের মা, ঘুমের ওষুধ আর নানান রকম পথ্য বিক্রি করতেন। একবার এলাকার প্রভাবশালী মহলের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ায়, সুযোগ বুঝে ডাইনির অপবাদ তারা দিয়ে দেয় তার উপরেও। গভীর রাতে একদল ধর্মান্ধ উন্মাদ এসে গ্রেফতার করে কেপলারের মা কে। কাপড় চোপড়ের এক বাক্সে করে নিয়ে যায় তাকে। বিচারে উদ্দেশ্যে।
কেপলারের সলোনিয়াম নামক কল্প বিজ্ঞান গল্পের নায়কের বাবা-মাও ওষুধ বিক্রি করতো। সেই গল্পের নায়কের মায়ের সাথে আত্মা প্রেতাত্মাদের যোগাযোগ ছিলো। এবং ঐ অভিযাত্রী চাঁদে যাওয়ার উপায় তাদের থেকেই পায়। কেপলার তার এই কল্পনাবিলাস নিয়ে লেখেন, “in a dream one must be  allowed the liberty of imagining occasionally that which never existed in the world of sense perception.” সেই ধর্ম যুদ্ধের কালে, সাইনফিকশন ছিলো আনকোরা এক আইডিয়া। আর এই বইকেই কেপলারের মায়ের ডাইনিত্বের প্রমাণ হিসাবে দায়ের করা হয়। চুহাত্তর বছর বয়স্ক সেই মহিলাকে এক দূর্গের অন্ধপ্রকষ্ঠে শিকল দিয়ে বেধে রাখা হয় শ্বাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে।
এমন অবস্থায় একজন বিজ্ঞানীর যা করার কথা কেপলার সেভাবেই অগ্রসর হন। কী কী ঘটনাকে মানুষ ডাকিনি বিদ্যার চর্চা হিসাবে ভুল করছে। এবং যেগুলোকে ডাকিনি বিদ্ধা বলা হচ্ছে সেগুলোর যে কোনো প্রাক্টিক্যাল ইম্প্যাক্ট নেই, সেসব প্রমাণ করতে সক্ষম হন তিনি। ফলে তার মা কে রেহাই দেওয়া হয়। অবশ্য সেই সঙ্গে নির্বাসন দেওয়া হয় ঐ এলাকা থেকে। এবং ওখানকার ডিউক ডিক্রি জারি করেন, যে এ ধরনের ডাইনি অভিযোগে আর যেন কাউকে গ্রেফতার করা না হয়। কেপলারে হাত ধরে আবারও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তির জয় হয়।
কেপলার বিশ্বাস করতেন, এমন এক দিন আসবে যখন হাওয়াই জাহাজ থাকবে, যেগুলো আকাশে-মহাকাশে ঘুরে বেড়াবে। যারা বয়ে নিয়ে যাবে সেইসব অভিযাত্রীদের যারা মহাকাশের বিশালতায় ভীত নয়।
মানুষ চাঁদে গিয়েছে। মানুষ হাওয়াই জাহাজ বানিয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা এমন একটা যুগে বাস করি, কেপলারের মত মহান মনীষীর কাছেও যা ছিলো কল্পবিজ্ঞান। এর কতটুকুই বা আমরা উপলব্ধি করি?
তার মৃত্যুর পর তার এপিটাফে লেখাছিলো স্বরোচিত দুই লাইন,
“I measured the skies, now the shadows I measure. Sky-bound was the mind, Earth-bound the body rests.”