Saturday, March 24, 2012

নক্ষত্রের কারিগর

বারো বছর বয়সী এক কিশোরের একবার ইচ্ছে হলো কাচের জারে একটা তারা তৈরি করবে। এরপর, তার বয়স চৌদ্দ পুরো হতে না হতে ঠিকই তেমন একটা তারা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিলো বিশ্বকে। না কোনো খেলনা তারা নয়। সত্যিকারের একটুকরো নক্ষত্রই বানিয়েছিলো সে। সূর্যের এবং অন্য আর সব নক্ষত্রের মধ্যে মধ্যে যেমন হাইড্রোজেন ফিউশন রিয়াকশনের মাধ্যমে অন্য পরমাণুতে পরিণত হয়। সঙ্গে উৎপন্ন হয় শক্তি, যেটাকে আলো আর তাপ হিসাবে আমরা দেখি, অনুভব করি। ঠিক তেমন নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার ঘটাতে পেরেছে সে তার বাড়ির গ্যারেজে। নিজের ছোট্টো পরমাণুগবেষণা কেন্দ্রে। ছেলেটির নাম টেইলর উইলসন। এভাবেই সে আরো একবার প্রমাণ করেছে, প্রচেষ্টা থাকলে কোনো স্বপ্নই অসম্ভব নয়।

ছোটোবেলা থেকেই টেইলর ছিলো কৌতূহলি। আর দশজন ছেলেমেয়ের মতই। তবে আর দশজনের থেকে তার পার্থক্য ছিলো উদ্যমে। কোনো একটা ব্যাপারে কৌতূহল বোধ করলে তা যতই জটিল মনে হোক, লেগে থাকতো সে। এবং এক সময় সেগুলো বুঝে ফেলতো ঠিকই। আসলে কোনো কিছু বুঝে ফেলার মধ্যে যে কী অভাবনীয় আনন্দ, তার খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলো সে আরও অনেক আগেই। তাই তো ৯ বছর বয়সে এক মহাশূন্য ও রকেট গবেষনাকেন্দ্রের  জাদুঘরে রকেট ইঞ্জিন দেখতে গিয়ে কীভাবে সেটা কাজ করে তার পুংক্ষাণুপুংক্ষ বর্ণণা দিয়ে চমকে দিয়েছিলো সবাইকে। পরে এক দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে রকেটসাইন্স রেখে পরমাণু গবেষণায় আগ্রহী হয়ে টেইলর।

সেই বছর তার দাদির মৃত্যু হয় ক্যানসারে। আমরা জানি ক্যানসার নামক এই মারণ ব্যাধির কোনো ভালো চিকিৎসা নেই। কেমোথেরাপি নামক এক রকম আংশিক চিকিৎসা প্রচলিত, যেখানে শরীরের মধ্যে বিষাক্ত সব রাসায়নিক দ্রব্য ঢুকিয়ে দেওআ হয়, আর আশা করা হয় এগুলো গিয়ে সেই ক্যানসার আক্রান্ত কোষগুলোকে মেরে ফেলবে। এমন এক ধরনের কেমো থেরাপিতে শরীরের মধ্যে তেজস্ক্রিয় পরমাণু ঢুকিয়ে দেওআ হয়। এরা গিয়ে তেজষ্ক্রিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেরা ক্ষয় হয়ে অন্য ধরনের পরমাণুতে পরিণত হয়, আর নানা রকম তেজষ্ক্রিয় রশ্মি বিকীরণ করে। আর এই রশ্মিগুলোই ক্যানসার কোষকে মেরে ফেলে। এক সময় এই ভয়ংকর পরমাণুগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। আর তখন যদি ক্যানসারকোষগুলো সব মারা গিয়ে থাকে, মানুষটি সুস্থ হয়ে ওঠে। যদিও এই চিকিৎসা সব সময় কার্যকর হয় না এবং প্রচুর সুস্থ কোষও মারা পড়ে এতে। কিন্তু এর চেয়ে খুব ভালো চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।

এখন এই তেজস্ক্রিয় পরমাণুগুলো যদি দ্রুত ক্ষয় হতে হতে নিঃশেষ না হয়ে দীর্ঘ্যদিন ধরে একটু একটু করে ক্ষয় হতো, তাহলে সেই আক্রান্ত ব্যক্তি হয়তো ক্যানসারের বদলে তেজস্ক্রিয়তায় ভুগতে ভুগতেই মারা পড়তো। এ কারণেই এই চিকিৎসায় শুধু সেইসব তেজস্ক্রিয় পরমাণু (এদের বলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ) ব্যবহার করা হয় যারা গঠনগত কারণেই বেশ দ্রুত ক্ষয় হয়। আর এখানেই দেখা দেয় সমস্যার। যে বড় বড় গবেষণাগারে এসব আইসোটোপ তৈরি হয়, সেখান থেকে খুব দূরের কোনো চিকিৎসা কেন্দ্রে ওগুলোকে নিতে নিতেই হয়তো ক্ষয় হয়ে নিঃশেষে হয়ে পড়ে এরা। এমন কি অনেক দূরের কোনো রোগীকে চিকিৎসা করতে কখনও প্রাইভেট জেটে করেও এগুলোকে দ্রুত বয়ে নিতে হয়। এদেরকে সংরক্ষণ করাও সম্ভব নয়। তাই সাধারণ কারো পক্ষে এই চিকিৎসা হয়ে পড়ে প্রায় অসম্ভব। টেইলর তার দাদির ক্ষেত্রেও এই কেমিক্যালগুলোর দুস্প্রাপ্যতা লক্ষ্য করেছিলো। আর তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয় এই অতিপ্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আইসোটগুলো নিজেই বানিয়ে ফেলবে সে। কিন্তু তেজস্ক্রিয় আইসোটপ সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি করা যায় না। এর জন্য লাগে নিউক্লিআর বিক্রিয়া। আর তার জন্য প্রয়োজন পারমানবিক চুল্লি। কিন্তু এই চুল্লি সে কোথায় পাবে?

আমরা অনেকে হয়তো পেপার-পত্রিকায় বা টিভি-ইনটারনেটে পরমাণুচুল্লি দেখে থাকবো। কিন্তু আমরা কি জানি, যে সৌরজগতের সবচেয়ে বড় পরমানুচুল্লিটাকে আমরা দেখি প্রতিদিনই? সেটা হচ্ছে সূর্য। শুধু সূর্য না, যে অসংখ্য তারা দেখি আমরা রাতে সেগুলোও একেকটা পরমাণুচুল্লি। এদের কেউ কেউ সূর্যের চেয়েও বড়, কিন্তু বহু আলোকবর্ষদূরে হওয়ায় এদেরকে ছোটো দেখায়। আর এদের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া। নির্দিষ্ট করে বললে হাইড্রোজেন ফিউশন বিক্রিয়া। যেখানে একাধিক হাইড্রোজেন পরমানু মিলে হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। আর নির্গত করে আলো সহ নানান রকম তেজস্ক্রিয় কণিকা। টেইলর সিদ্ধান্ত নেয় নিজের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য এমন এক টুকরো তারাই বানিয়ে ফেলবে সে। যাতে সেই বিক্রিয়ায় উৎপন্ন নিউট্রনের সাহায্যে কেমোথেরাপিতে প্রয়োজনীয় আইসোটোপগুলো বানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়। আর শুধু এই তেজস্ক্রিয় বিক্রিয়া ঘটাতে পারলেই চলবে না, তার ফিউশন রিয়্যাক্টরটিকে হতে হবে ছোটোখাটো। যেন দূর দূরান্তের হাসপাতালগুলোতে এ ধররনের রিয়াক্টর বানিয়ে সেখান থেকেই কেমোথেরাপির জন্য প্রয়োজনীয় রেডিও আইসোটোপ তৈরি করা সম্ভব হয়। আর এভাবেই সে স্বপ্ন দেখে কাঁচের জারে একটা তারা তৈরির।

টেইলর উইলসন একজন কিশোর হলেও সে হচ্ছে সেই শ্রেণীর মানুষ যারা নিজের স্বপ্নকে অবহেলায় দূরে ঠেলে দিতে পারে না। পাঠিয়ে দিতে পারে না বৃদ্ধাশ্রম বা কোনো অনাথ আশ্রমে। কবর দিতে পারে না, কোনো অসম্ভবের ভয় বা আলস্যের নীচে। তাই এই স্বপ্নটাকে বাস্তবায়নের জন্যও সে উঠে পড়ে লাগে। একে একে শিখে নেয় ক্যালকুলাস সহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের গণিত, আধুনিক পদার্থবিদ্যা, আর রসায়ন। ফিউশন বিক্রিয়ায় ঘটার সময় ৫০০ মিলিয়ন ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রার প্লাজমা উৎপন্ন হয়। এটাকে পৃথিবীর কোনো পাত্রেই রাখা সম্ভব নয়। যেকোনো কিছুকেই গলিয়ে নিমেষে ধ্বংস করে ফেলবে সেটা। তাই এই প্রচন্ড ফিউশন বিক্রিয়ার প্লাজমাকে চৌম্বক ও তড়িৎক্ষেত্রের মধ্যে ভাসিয়ে রাখতে হয় সুক্ষ্ম ভারসাম্যে। ইরেনিয়াম দিয়ে যে পারমানবিক চুল্লি চালানো হয়, সেখানে হয় ফিশান বিক্রিয়া। অর্থাৎ বড় একটা পরমাণু ভেঙ্গে ছোটো ছোটো পরমাণু তৈরি হয় ওতে। এই বিক্রিয়ার বিঃধ্বংসি ক্ষমতা আমরা সবাই জানি। দুর্ঘটনার আশংকাও থাকে তাই অনেক। কিন্তু টেইলরের বিক্রিয়াটা 'ফিউশন' বিক্রিয়া। যেখানে ছোটো ছোটো হাইড্রোজেনের পরমানু (আসলে হাইড্রোজেনের ডিউটেরিআম নামক একটা আইসোটোপ) মিলে বড় হিলিয়াম পরমাণু তৈরি করে। এই বিক্রিয়াকে চালিয়ে নিতে এর প্লাজমাকে খুব সূক্ষ্মভাবে শূন্যে ভাসিয়ে রাখতে হয়। একটু এদিক ওদিক হলেই এটা কোনো কিছুর সংস্পর্শে এসে, তাপমাত্রা হারায়, এবং বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তাই ফিউশন বিক্রিয়ায় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সূর্যের কেন্দ্রের মত উত্তপ্ত এই প্লাজমা কেন্দ্রকে সুক্ষ্মভাবে ভাসিয়ে রাখা যেনতেন কথা নয়। তড়িৎচৌম্বকত্বের গুড়তত্ত্বগুলো শিখে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলো বানাতেঅ জানতে হবে। টেইলর একে একে শিখে নেয় সবই। তৈরিও করে ফেলে সব, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। শুনতে অসম্ভব মনে হলেও নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভয় না পেলে যে কোনো কিছুই সম্ভব সেটা প্রমাণ করে ছাড়ে সে। তার বাড়ির গ্যারেজে, সে বানাতে সক্ষম হয় একটা প্রচন্ড উজ্জ্বল নীলচে বেগুণী তারা।

এখানেই থেমে থাকেনি টেইলর। এগুলোর সাহায্যে ঠিকই, কেমোথেরাপিতে প্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আইসোটোপও বানাতে সক্ষম হয় সে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের জন্য কয়েকশ ডলার দামের এমন একটা [বিষফোরক সনাক্তকারী] ডিটেক্টরও বানাতে সক্ষম হয়, যেটা লক্ষ ডলারের ডিটেক্টরের থেকেও শত গুণে বেশি সংবেদনশীল। টেইলর মনে করে এই ফিউশন বিকারকের মাধ্যমেই একদিন বিশ্বের শক্তির চাহিদা পূরণ হবে।

এতকিছু শেখার জন্য টেইলর নানান সময়ে যোগাযোগ করেছে, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের সাথে। তারাও সাগ্রহে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে তথ্যের মূল উৎস ছিলো ইনটারনেট। 'ফিউজর ডটনেট' [১] নামক একটা ওয়েবসাইটই আছে, যেখানে ফিউশন বিকারক বা ফিউজর বানানোর উপায় নিয়ে আলোচনাকরে আগ্রহীরা। নিজেদের আবিষ্কারকে একে সবার সাথে উন্মুক্তভাবে শেয়ারও করে। ইনটারনেট সংযোগ আছে, এমন প্রতিটি মানুষের নাগালের মধ্যেই আছে পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে সকল তথ্য। চাই শুধু স্বপ্ন দেখার আর তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পরিশ্রমের সাহস।

সূত্র:-
[১] ফিউজর ডট নেট http://www.fusor.net/
[২] টেইলরকে নিয়ে 'পপুলার সাইন্স' নামক অলনাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আর্টিকেল http://www.popsci.com/science/article/2012-02/boy-who-played-fusion?page=all
[৩] টেইলর এর টেড প্রোফাইল - http://www.ted.com/speakers/taylor_wilson.html
[৪] টেইলরের নিজস্ব ওয়েবসাইট - http://sciradioactive.com/Taylors_Nuke_Site/About_Me.html

[৫]  টেইলরের তিন মিনিট দীর্ঘ টেড বক্তৃতা - -

Yup, I built a nuclear fusion reactor




1 comment:

  1. অসাধারণ । এই ধরনের স্বপ্নবাজদের দেখলে নিজেরও স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে ।

    ReplyDelete