ছেলেবেলায় ছড়া শুনেছিলাম, বাঙালি মানুষ নয়, জন্তু। শুনে নিজের জাতি সম্পর্কে সন্দেহ জেগেছিলো; তবে বিশ্বাস হারাই নি। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো নাকি পাপ; আর একটা পুরো জাতির ওপর বিশ্বাস হারানো তো মহাপাপ। ছেলেবেলায় অতো বড়ো পাপের সাহস হয় নি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সপ্তকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/রেখেছ বাঙালি ক’রে মানুষ করো নি।’ এখানে ‘বাঙালি’ শব্দটির অর্থ কী? অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীবদের জ্বালায় কি অত্যন্ত অতিষ্ঠ হয়েছিলেন বাঙালির মহাকবি? শেষ জীবনে কেনো তিনি জানিয়ে গেলেন, বাঙলায় আর নয়? যদি আবার জন্ম নিতে হয়, তাহলে হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে। বাঙলায় নয়। বাঙালির চরিত্র দেখে দেখে ঘেন্না ধ’রে গিয়েছিলো তাঁর মনে। জীবনানন্দ শালিকটালিক হয়ে জন্মাতে চেয়েছিলেন, বাঙালি হিশেবে নয়। বিদ্যাসাগর শেষ জীবনে বাঙালির ওপর বিশ্বাস হারাতে হারাতে মানুষের ওপরেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বর গুপ্তকে বলেছিলেন ‘খাঁটি বাঙালি’ কবি। খাঁটি হওয়া খুব ভালো, তবে তিনি এও জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাঙলার অবস্থা আবার অধঃপতনের দিকে না গেলে খাঁটি বাঙালি কবি ‘জন্মাবে না, জন্মিয়া কাজ নাই’। দেখতে পাচ্ছি প্রধান বাঙালিরা সবাই বিরূপ বাঙালির ওপর। নিশ্চয়ই বাঙালির কোনো অসামান্য প্রতিভা রয়েছে, যা এমনভাবে হতাশ, বিরূপ, অবিশ্বাসী করে মহৎদের। মিলটনের স্বর্গচ্যুতি মহাকাব্যে স্বর্গ থেকে বহিস্কৃত শয়তান বঙ্গোপসাগর এলাকা দিয়েই নেমেছিলো পৃথিবীতে। ওই প্রথম পতনের সংস্পর্শ কি বাঙালিকে চির অধঃপতিত করে রেখেছে? মালার্মে একটি কবিতায় এমন একটি পাখির কথা বলেছেন, যার বিলুপ্তি আসন্ন। ওই পাখিকে তিনি তুলনা করেছেন বাঙালির সাথে। বাঙালি কি তবে সেই নিয়তিদণ্ডিত জাতি, যার ভাগ্যে রয়েছে শুধু নিন্দা, আর অবলুপ্তি?
পৃথিবীর প্রতিটি জাতিরই কোনো-না-কোনো সদগুণ রয়েছে। স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ওই বৈশিষ্ট্য তাকে পৃথক ক’রে রাখে অন্যান্য জাতি থেকে, ক’রে রাখে বিশিষ্ট। বাঙালির কি অমন কোনো বৈশিষ্ট্য রয়েছে? রয়েছে কোনো সদগুণ? তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য সম্ভবত বাঙালির নেই। বাঙালির চরিত্রে গুণের থেকে দোষের পরিমাণ যে অনেক বেশি তাতে সন্দেহ নেই। এ জন্যেই তার প্রধান পুরুষেরা বিরূপ তার ওপর। মধুসূদন কি বাঙালি ছিলেন, বাঙালি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ? বিদ্যাসাগর কি বাঙালি ছিলেন, বাঙালি ছিলেন বাঙলার অন্যান্য মহাপুরুষ? মনে হয় তাঁরা বাঙালি ছিলেন না। বাঙালি জাতির প্রধান পুরুষ বা মনীষী তাঁরাই, যাঁরা পেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন বাঙালিত্বকে। তাই প্রধান বাঙালি হ’তে হ’লে হ’তে হবে অবাঙালি। হয়তো চরিত্র অর্জন করতে হবে জর্মনের, বা ইংরেজের, জাপানির বা চীনের, ফরাশির বা মার্কিনের বা রুশির। খাঁটি বাঙালি হয়ে মহৎ বাঙালি হওয়া অসম্ভব। বাঙালি বলতে বোঝায় সামান্যতা, হীনতা, তুচ্ছতা। তার চরিত্রের বদগুণের বীজ কিলবিল করে।
কী কী মুক্তোয় খচিত সোনার বাঙালির সোনার চরিত্রটি? বাঙালির চরিত্রমুকুটের কোহিনূর কোনটি বলা মুশকিল, প্রতিটিই রঙে শোভায় আকারে হারিয়ে দিতে চায় প্রতিটিকে। তাই ঐসব মণিমুক্তোর তালিকা ক্রম রেখে তৈরি করা কঠিন। খুব বড়ো ধরনের গবেষণাপ্রকল্প দরকার। বাঙালি মিথ্যুক। মিথ্যা ব’লে চালিয়ে দিতে পারলে সত্য বলার কষ্টটুকু করবে না। বাঙালি প্রতারক। প্রতারণা করতে পারলে বাঙালি বিশেষ তৃপ্তি পায়। আরেকটি প্রতারককে ঠকাতে পারা কি অসামান্য সুখ আর গৌরবের কথা নয়? ব্যবসায় তো প্রতারণাই ধর্ম। দলবেধে ব্যবসায় নেমে বাঙাল এবং একজন অন্যদের ঠকিয়ে বাড়িগাড়ি করে। দু-দিন আগে মুদি দোকান থেকে বাসায় একটি ঠোঙা আসে। তাতে লেখা একটি চিঠি। পত্রলেখক লিখেছেন, ‘আপনার সঙ্গে আর ব্যবসা করিব না। নামাজ-রোজা করেন দেখিয়া ভাবিয়াছিলাম আপনি সৎ। এখন দেখিলাম আপনি অসৎ। আগামী কাল আমার মালগুলি ফিরত দিবেন। নইলে ভালো হইবে না’। প্রতারণা চলছে দিকে দিকে, প্রতারণা ছাড়া বাঙালির ঘরে আলো জ্বলে না। বাঙালি ভণ্ড। ভণ্ডামোতে একশো নম্বর দিতে হবে তাকে। যা বিশ্বাস করে না, তা অবলীলায় ব’লে যাবে। আমলা কবিদের কবিতা প’ড়ে দেখুন। কী দারুণ বিপ্লবী আর প্রগতিশীল তারা। স্যার, স্যার বলতে বলতে থুতু উপচে পড়ছে; কিন্তু কবিতা লিখতে বসলেই বিদ্রোহী, প্রতিবাদী। জনগণের সাথে একাত্ম। বাঙালি চিন্তা করে, চিৎকার করে। আসুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায়, দেখবেন ইলশের বাজারকে ছাড়িয়ে গেছে জ্ঞানকেন্দ্রের করিডোর। অফিসে যান, দেখবেন নিজের টেবিলে কেউ নেই; দোস্তের টেবিলে ব’সে গলা ফুলিয়ে চিৎকার ক’রে চলেছে দায়িত্বশীল বাঙ্গালিগণ।
বাঙালি অলস; বাঙালি ফাঁকি দিতে পারলে ধন্য বোধ করে। কাউকে একটা কাজ দিয়ে চ’লে আসুন, দেখবেন সেটির ওপর কেমন দায়িত্ব পালন চলছে। তাড়া না দিলে এ-গাধা চলে না। লোভের কথা বলবো? লোভে তো লকলক করে বাঙালির সমস্ত শরীর। শরীরটাই একটা বড়ো জিভ হয়ে ওঠে। বাঙালি স্বৈরাচারী ও ক্রীতদাস। ওপরে যে আছে, তার মতো শক্তিমান আর কেউ নেই। তার কথাই শেষ। সে সব জানে, সব বোঝে। নিয়মগুলো তৈরি হয়েছে শুধু সে খানখান ক’রে ভেঙে ফেলবে ব’লে। যাচ্ছেতাই না করতে পারলে শক্তির প্রকাশ কোথায়? প্রতিটি অফিসে একেকজন অসামরিক জেনারেল ব’সে আছেন। বাহুতে বুকে শেলাইকরা তারাটারা নেই, কিন্তু শতোশতো তারা জ্বলছে ব্যক্তিত্বে। অফিসের বড়োবাবুকে সম্মান জানাতে হয়; ‘স্যার’ বলতে হয়। আজকার তার তাতে চলছে না, তাই ‘শ্রদ্ধেয় স্যার’ বলতে হয়। না ব’লে উপায় নেই, নিচের সবাই দাস। জনগণের পয়সায় কেনা দাস। আবেদনপত্র লিখতে হ’লেই সম্বোধন করতে হয় ‘মাননীয়’, ‘মহামান্য’। যে-কোনো অফিসের বড়োসাহের সচিবালয়ের বড়োসাহেবের কাছে গেলেই আবার ক্রীতদাস। লেজ নড়তে থাকে, লেজ নড়তে থাকে। ডারউইনি লেজটি তার মুখগহ্বরে। অন্যরা বানরের বংশধর হ’তে পারে, বাঙালি প্রভুভক্ত জীবের বংশধর; তবে বাঙালি প্রভুভক্ত নয়। বাঙালি মিথ্যুক প্রতারক, ভণ্ড, অলস, স্বৈরাচারী, ক্রীতদাস, চিৎকারপরায়ণ, কাপুরুষ, লোভী, পরশ্রীকাতর, নিন্দুক, গোপনে কামুক প্রকাশ্যে সন্ত, নির্লজ্জ, অসুস্থ, চক্রান্তপরায়ণ, বিশ্বাসঘাতক, দায়িত্বহীন, সময়জ্ঞানহীন, অবিবেচক, নির্মম, অমানবিক, অনুদার, অসৎ, পরপীড়ক, অগণতান্ত্রিক, বিলাসী, খল, যুক্তিহীন বাচাল এবং আরো একশো একটি মুক্তোর সমষ্টি। এ-জন্যেই হয়তো পরাধীন থেকেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী। যে-ই বিদেশ থেকে হানা দিয়েছে, তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বাঙালি। মধ্যযুগে খুব বড়ো বাঙালির পরিচয় বিশেষ পাওয়া যায় না। বড়ো বাঙালিরা আবির্ভূত হতে থাকে উনিশশতকে।
উনিশশতকই হচ্ছে মহৎ বাঙালিদের শতাব্দী। এই মহতেরা কীভাবে জন্মালেন? এর একটা কারণ সম্ভবত ইংরেজদের সংস্পর্শ। ইংরেজের চরিত্রের যে-প্রচণ্ড শক্তি, তার কিছুটা সংক্রামিত হয়েছিলো বিদ্যাসাগর, রামমোহন, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও আরো কারো কারো চরিত্রে। খাঁটি বাঙালিরা মহৎ বাঙালি নয়, বাঙলার বিবর্তনে তাদের কোনো অবদান নেই। বিশশতকেও যাঁরা প্রধান হয়েছেন, তাঁরা খাঁটি বাঙালি নন, তাঁদের মধ্যেও ইউরোপীয় চরিত্রের মিশেল রয়েছে। সুভাষ বসু বাঙালি? মনে হয় জাপানি বা জর্মন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাঙালি? বাঙালি হ’লে তো দু’একটি ছিঁচকে বই লিখেই শিষ্যদের মুখে মুখে অমর মনীষী হয়ে যেতেন। তিনি যে-বিশাল বই লেখার দুঃসাহস দেখালেন, এতে তাঁকে জর্মন না মনে ক’রে উপায় নেই। এমন উচ্চাভিলাষ কি বাঙালির আছে! বাঙালি ক্ষুদ্র এবং চারপাশের সবকিছুকে ক্ষুদ্র ক’রে রাখতে চায়। এর প্রমাণ পাই বাঙালির প্রিয় প্রবাদে। ভূয়োদর্শী প্রবাদপ্রণেতা পরামর্শ দিয়েছেন, বেশি বড়ো হয়ো না ঝড়ে ভেঙে পড়বে, বেশি ছোটো হয়ো না ছাগলে খেয়ে ফেলবে। বাঙালি আকাশচুম্বী হবে না, তার দর্শন ছাগলের নাগালের ওপরে ওঠা। কিন্তু অধিকাংশই উঠতে পারে না। বাঙালি, তুমি কবে তোমার চরিত্রের মুক্তোগুলো খুইয়ে মানুষ হবে?
হুমায়ূন আজাদের এই লেখাটি সংগ্রহ করেছি Anik Andalib-এর ফেসবুক পাতা থেকে।